• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১৩ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভালোবাসার রঙ যেন ডালা মেলেছে প্রতিবন্ধী দম্পতির 


বগুড়া প্রতিনিধি
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২২, ০৭:০৮ পিএম
ভালোবাসার রঙ যেন ডালা মেলেছে প্রতিবন্ধী দম্পতির 

বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী দম্পতি ইমদাদুল হক এবং সুমনার টিনেরচাল দেওয়া আধা-পাকা ঘরটি যেন প্রেমের তাজমহল। ২৪ বছর বয়সী ইমদাদুল ও তার স্ত্রী ২০ বছর বয়সী সুমনা খাতুন স্নায়ুবিক বিকাশ সংক্রান্ত রোগে আক্রান্ত। ইমদাদুল বগুড়া সদরের চাঁদমুহা হাটের পলাশবাড়ী গ্রামের বাসিন্দা। তার বাবা আব্দুল জলিল পেশায় দিনমজুর।

ইমদাদুলের মা রোকেয়া বেগম মারা গেছেন অনেক আগেই। এদিকে কনে সুমনা বেগম সদর উপজেলার হাজরা দীঘি আশোকোলা দক্ষিণপাড়ার ইসলাম উদ্দিন ও মনোয়ারা বেগমের মেয়ে। ইসলাম পেশায় ভিক্ষুক।

তারা দুজনে বগুড়ার ঠেঙ্গামারা মহিলা সবুজ সংঘ (টিএমএসএস) অটিজম ও বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী স্কুল এবং পুনর্বাসন কেন্দ্রের সাবেক শিক্ষার্থী। আর বিয়ের পরে এটি তাদের প্রথম বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস। তাই ইমদাদুল ও সুমনা দম্পতির প্রথম বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস উদযাপনে ছিল না কোনো কমতি। ফাগুনের হাওয়ায় ভালোবাসার রঙ যেন ডালা মেলেছে তাদের মনে। ভালোবাসা দিবসে তাদের ঘরে উঁকি দিয়েছে ঋতুরাজ বসন্ত। দুজনই সেজেছেন বাসন্তী সাজেও।

সুমনার সব খুনসুটি তাই প্রতিদিনের কাজের শেষে ঘর সংসারের পাশাপাশি ভালোবাসার মানুষ ইমদাদুলকে ঘিরে। পাশাপাশি সুমনাকে রান্নার কাজে সাহায্য করেন ইমদাদুল; কখনও বা কাপড়-চোপড় ধুয়েও প্রিয়তমার কাজের চাপ কমান। ওই পুনর্বাসন কেন্দ্রেই তারা দুজন প্রেমে পড়েন। তিন বছর ধরে তাদের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক ছিল। অবশেষে পরিবারের সবার সম্মতিতে চূড়ান্ত পরিণয় হয় তাদের।

তাদের নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রায় এক হাজারেরও বেশি মানুষের উপস্থিতিতে জমকালো অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের বিয়ে দেওয়া হয়। বগুড়ার সদর উপজেলার নওদাপাড়া এলাকায় নানারকম সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে টিএমএসএসের রিলিজিয়ন কমপ্লেক্স। তার পাশেই টিনের চাল দেওয়া আধা-পাকা ঘরে ইমদাদুল ও সুমনার সংসার।

প্রথম বসন্ত ও ভালোবাসা দিবস নিয়ে সঙ্গে কথা হয় এই দম্পতির। তারা জানান, তিন বছরের প্রেম শেষে সারা জীবনের বন্ধনে পথচলায় প্রথম বসন্ত ছিল এটি। তাই সারাদিন একসঙ্গে ঘোরাফেরা করেছেন তারা।

সুমনা জানান, ঘোরাফেরা শেষে খেয়েছেন চটপটি ও ফুচকাও। সঙ্গে ইমদাদুল যোগ করে জানান, বাদাম ভাজা ও মটরভাজাও খেয়েছিলেন। এছাড়াও পাশাপাশি বসে সুন্দরভাবে গল্প ও অনেক আনন্দ করেছেন দুজনে মিলে। বিয়ের পর তাদের কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হয়েছে। ইমদাদুল টিমএসএসের ক্ষুদ্র কুটির শিল্পে সুতার বস্তা বানানোর কাজ করছেন। আর সুমনা কাজ করছেন রিলিজিয়ন কমপ্লেক্সের ক্যান্টিনে আয়া হিসেবে। তাদের বেতনের টাকা নিজ নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পাশাপাশি তাদের থাকা, খাওয়া এবং চিকিৎসার সব ব্যয়ভার বহন করছে টিমএসএস কর্তৃপক্ষ।

ইমদাদুল জানান, তিনি কখনও ভাবতে পারেননি সুমনার সঙ্গে তার সংসার হবে। সুমনাকে তিনি অনেক ভালোবাসেন। একটানা তিন বছর তারা প্রেম করেছেন। পুনর্বাসন কেন্দ্রে সবাই তাদের প্রেমের বিষয়টা জানতেন। এখন তারা অনেক ভালো আছেন। তাই বিয়ের পরে প্রথম বসন্তের মতো সৃষ্টিকর্তার কাছে জীবনে আরও শত বসন্তের আবেদন তার।

সুমনা জানান, ইমদাদুলকে স্বামী হিসেবে পেয়ে তিনি অনেক খুশি। তাদের প্রেম সার্থক হয়েছে। তারা সংসার জীবনে অনেক সুখি। পাশাপাশি ভালোবাসা দিবস ও বসন্তে ইমদাদুলের কাছ থেকে ফুল পাওয়াটা তার কাছে আজীবন অম্লান স্মৃতি হয়ে থাকবে।

গত বছর ২১ অক্টোবর তাদের বিয়ের আয়োজনে ছিল না কোনো কমতি। প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শিক্ষক-কর্মচারী আর শিক্ষার্থীরা মিলে গায়ে হলুদ থেকে বিয়ের অনুষ্ঠান সব করেছেন রীতিমতো ধুমধাম করে। ১৭ অক্টোবর সন্ধ্যায় গায়ে হলুদ আয়োজনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় তাদের বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা। স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে নাচ, গান পরিবেশনসহ আনন্দে মেতেছিলেন স্কুলের শিক্ষক, শিক্ষার্থীসহ আমন্ত্রিত অতিথিরা।

পরদিন সোমবার দুপুরে বিয়ে পড়ানোসহ অতিথি আপ্যায়নের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় বিয়ের উৎসব। তাদের বিয়ের আয়োজনে প্রীতিভোজে আমন্ত্রিত ছিলেন এক হাজারেও বেশি অতিথি। তাদের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানও জাঁকজমকভাবে করা হয়েছিল। ওই অনুষ্ঠানেও বর-কনের পরিবারের ২০ জন ছাড়াও ৫০০ অতিথি উপস্থিত ছিলেন। সব আয়োজন শেষে শুরু হয় এক প্রতিবন্ধী জুটির বিবাহিত জীবন। টিএমএসএস প্রতিবন্ধী স্কুল কর্তৃপক্ষ ৫ বছর ধরে তাদের সব দায়িত্ব পালন করে আসছে। ওই স্কুলেই তারা লেখাপড়া ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন।

টিএমএসএসের রিলিজিয়ন কমপ্লেক্সের প্রশাসনিক কর্মকর্তা সোহরাওয়ার্দী বারি জানান, ইমদাদুল ও সুমনা সুস্থ অবস্থায় ভালোভাবে সংসার করছেন। যেহেতু তারা বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী এজন্য পরিবারের কাছে তাদের থাকার সুযোগ নেই। এখানে সার্বক্ষণিক মনিটরিংসহ সব রকম চিকিৎসা তাদের দেওয়া হয়।

রিলিজিয়ন কমপ্লেক্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দা রাকিবা সুলতানা জানান, লেখাপড়া ও কারিগরি শিক্ষা গ্রহণ করে অনেকটাই স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসেছেন ইমদাদুল ও সুমনা। তাদের বেতনের টাকা নিজ নিজ ব্যাংক অ্যাকাউন্টে জমা হয়। পাশাপাশি তাদের থাকা, খাওয়া এবং চিকিৎসার সব ব্যয়ভার বহন করছে টিমএসএস কর্তৃপক্ষ।

Link copied!